মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মতের জন্য জাকাত নামের একটি আর্থিক ব্যবস্থা রেখেছেন। এটি সামাজিক কল্যাণ, অনৈতিক ভারসাম্য, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতিপালনে একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়।
মহানবী (সা.) জাকাতের সময়, পরিমাণ, নিসাব (যে পরিমাণ সম্পদ হলে জাকাত দিতে হয়), যাদের ওপর তা ফরজ, যারা জাকাতের উপযুক্ত সব কিছু সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।
জাকাতব্যবস্থা প্রণয়নে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ধনী ও দরিদ্র উভয় শ্রেণির স্বার্থের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা সম্পদশালী ও তার সম্পদকে পবিত্র করার জন্যই জাকাত ফরজ করেছেন। এর মাধ্যমে ধনীদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহগুলো রক্ষা পায়। যে ব্যক্তি তার সম্পদের জাকাত আদায় করে সে অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলা থেকে মুক্তি পায়, তার সম্পদে বরকত হয় এবং তাতে প্রবৃদ্ধি আসে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) যদি কোনো লোকের অবস্থা দেখে বুঝতে পারতেন সে জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত, তাহলে তিনি তাকে জাকাত দিতেন। আর এমন কোনো লোক যদি জাকাত চাইত, যার ব্যাপারে জানা যায় না যে সে জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত কি না, তাহলে তাকেও তিনি জাকাত দিতেন। এরূপ হলে তিনি বলে দিতেন যে ধনী ও উপার্জন সক্ষম শক্তিশালী যুবকের জন্য জাকাতের কোনো অংশ নেই।
মহানবী (সা.)-এর নিয়ম ছিল এলাকার ধনীদের থেকে জাকাত সংগ্রহ করা হতো; সেই এলাকার জাকাতের হকদার তথা দরিদ্রদের মধ্যে তা বণ্টন করতেন।
বণ্টনের পর যা অতিরিক্ত হতো তা তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখা হতো। পরে তিনি তা পুনর্বণ্টন করতেন। এ জন্যই তিনি জাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারীদের গ্রামাঞ্চলে পাঠাতেন; শহরে পাঠাতেন না, বরং মুআজ (রা.)-কে ইয়েমেনের ধনী লোকদের থেকে জাকাত আদায় করে স্থানীয় জাকাতের হকদার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার আদেশ দেন। তিনি চতুষ্পদ জন্তু, শস্যদানা এবং ফলের মধ্য থেকে কেবল প্রকাশ্য মালের মালিকদের কাছেই কর্মচারীদের পাঠাতেন। তিনি খেজুর ও আঙুরের মালিকদের কাছে কেবল অনুমানে পারদর্শী লোকদেরই পাঠাতেন।
তাঁরা খেজুরের বাগানের মালিকের খেজুর এবং আঙুরের বাগানের মালিকের আঙুর অনুমান করে জাকাত নির্ধারণ করতেন। তাঁরা অনুমান করে দেখতেন বাগানে কত ওয়াসাক (তৎকালীন পরিমাপের একক) ফল হতে পারে। সেই অনুপাতে জাকাত নির্ধারণ করা হতো।
তিনি অনুমানকারীদের আদেশ দিতেন—তাঁরা যেন বাগানের এক-তৃতীয়াংশের খেজুর অনুমান না করেই ছেড়ে দেন। কেননা খেজুরের বাগান বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ নয়। অনুমান করার কারণ এই যে যাতে বাগান থেকে ফল ওঠানো এবং তা থেকে কিছু খেয়ে ফেলার আগেই জানতে পারা যায় যে তাতে কী পরিমাণ জাকাত আবশ্যক হয়েছিল। ফল গাছে থাকতেই অনুমান করার আরেকটি উপকার হলো তাতে বাগানের মালিক পরে ইচ্ছামতো তাঁর বাগানের ফলে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন এবং ফল ওঠানোর সময় জাকাত আদায়কারীদের অপেক্ষায় থাকতে হবে না।
ঘোড়ার জাকাত আদায় করা তাঁর নিয়মভুক্ত ছিল না। এমনিভাবে ক্রীতদাস, খচ্চর, গাধা, শাক-সবজি, তরমুজ এবং সেসব ফলের ওপরও জাকাত নির্ধারণ করেননি, যা ওজন করা হয় না এবং গোদামজাত করে দীর্ঘদিন রাখা যায় না। তবে আঙুর ও কাঁচা খেজুরের কথা ভিন্ন। তিনি কাঁচা খেজুর ও শুকনা খেজুরের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি। কোনো লোক জাকাতের মাল নিয়ে এলে রাসুল (সা.) তাঁর জন্য দোয়া করতেন—‘হে আল্লাহ! আপনি তাঁর মধ্যে এবং তাঁর উটের মধ্যে বরকত দান করুন।’
(সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৪৫৮)
কখনো কখনো তিনি দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি তাঁর ওপর রহমত বর্ষণ করুন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩৫৯)
জাকাত আদায় করার সময় শুধু ভালো সম্পদগুলো বেছে নিতেন না, তিনি মধ্যমমানের সম্পদগুলো গ্রহণ করতেন। তিনি দানকারীকে দানের সম্পদ ক্রয় করতে নিষেধ করতেন। কোনো দরিদ্র লোককে জাকাত দেওয়া হলে সে ব্যক্তি যদি ধনী লোককে উপহার হিসেবে সেখান কিছু দেয়, তবে ধনীর জন্য তা ভোগ করার অনুমতি দিয়েছেন। কখনো কখনো তিনি জাকাতের সম্পদ থেকে ঋণ নিয়ে মুসলিমদের স্বার্থে (রাষ্ট্রীয় কাজে) ব্যয় করতেন। তিনি নিজ হাতে জাকাতের উটগুলো চিহ্নিত করতেন। প্রয়োজন পড়লে তিনি ধনীদের থেকে অগ্রিম জাকাত আদায় করতেন। যেমন তিনি তাঁর চাচা আব্বাস (রা.) থেকে দুই বছরের জাকাত অগ্রিম নিয়েছিলেন।
নবীজি (সা.) প্রত্যেক ব্যক্তি ও তাঁর অধীন ছোট-বড় সবার ওপর ফিতরা আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হচ্ছে এক ‘সা’। চাই তা খেজুর হোক কিংবা যব হোক বা পনির কিংবা কিশমিশ হোক। এক সা আটার কথাও হাদিসে এসেছে। অন্য এক বর্ণনায় উপরোক্ত বস্তুগুলোর এক ‘সা’র বদলে গমের অর্ধ ‘সা’ দেওয়ার কথাও এসেছে। ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা আদায় করা নিয়ম ছিল। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ঈদের নামাজের উদ্দেশে বের হওয়ার আগেই ফিতরা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি)
মহানবী (সা.)-এর নিয়ম ছিল, তিনি কেবল ফকির-মিসকিনদেরই সদকায়ে ফিতর দান করতেন। আট প্রকারের খাতের মধ্যে থেকে তাদের ছাড়া অন্য কাউকে তিনি তা থেকে দান করতেন না। তাঁর পরে সাহাবি ও তাবেঈরাও তা করেননি।
আল্লাহ সবাইকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্ণ আনুগত্য করার তাওফিক দিন। আমিন।