আজকের গোবিন্দাসী গরু হাটের অধঃপতনের পেছনের পেছনে যারা – Newsroom bd24.
ঢাকাসোমবার , ৪ জুলাই ২০২২

আজকের গোবিন্দাসী গরু হাটের অধঃপতনের পেছনের পেছনে যারা

শেখ রুবেল, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি।
জুলাই ৪, ২০২২ ৬:৪৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

 

একসময়ে হাঁক-ডাক, চিৎকার আর কোলাহলে খুব সাত সকালেই মানুষের ঘুম ভেঙে যেতো। মানুষের কাজের ব্যস্ততার ছুটাছুটি ও যানবাহনের চলাচলে মুখরিত থাকতো আশেপাশের পরিবেশে। সকাল থেকেই বেঁচাকেনার ধুম পড়ে যেতো। এমতবস্থায় পারিপার্শ্বিক অবস্থাই জানান দিতো যে হাটের দিন এসেছে। আজ দেশের সেই অন্যতম দ্বিতীয় বৃহত্তম গোবিন্দাসী গরুর হাটটি তার গৌরব হারিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় লড়ে যাচ্ছে।

আর মাত্র কয়েকদিন বাকি পবিত্র ঈদুল আযহা। এ ঈদকে সামনে রেখেও এখনো জমে উঠে নি কোরবানি পশুর হাট। তবে এ হাটে এক সময় এক মাস আগেই কোরবানি পশুর বেঁচাকেনা জমে উঠতো। ওই সময়ে হাট সাড়ে ৪ কোটি টাকায় ইজারা নিয়েও লাভের মুখ দেখতেন ইজারাদাররা। তখন ঈদের আগ মুহুর্তে একটি হাটে ৮০ থেকে ৯০ লাখ পর্যন্ত রওনার টাকা সংগ্রহ হতো । আর বর্তমানে হাটের ইজারা কমে ৫২ লাখ টাকায় নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন ইজারাদার এবং ঈদ হাটে রওনা সংগ্রহ টাকা নেমে এসেছে সর্বোচ্চ ৬ থেকে ৭ লাখ টাকায়। হাটের ইজারা ও অর্থ সংগ্রহ এর নিন্মগ্রামী বলে দিচ্ছে হাটের আজ কতটা অধঃপতন হয়েছে ও হাট আজ কতটা অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। হাটের এমন অধঃপতনের পেছনে হাজারও বেশি প্রশ্ন রয়েছে এলাকাবাসীর।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আঁশি দশকের শুরু থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব গোল-চত্বরের ৭ কিমি উত্তরে ভূঞাপুর উপজেলার যমুনা নদীর তীরবর্তী গোবিন্দাসী এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে গোবিন্দাসী গরুর হাট।

সড়ক, নদীপথ ও রেলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে হাটটি সারাদেশে পরিচিত লাভ করে। ধীরে ধীরে হাটটি সম্প্রসারণ হতে থাকে এবং অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা হাটে আসতে থাকে। এছাড়াও দেশি-বিদেশী ও ভারতীয় গরু আসায় খুব অল্প সময়েই দেশের পাইকারদের নজর কাড়ে এই গোবিন্দাসী গরুর হাট। এরপর ৯০ দশকে এসে জমজমাট গরুর হাটে পরিণত হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ হাটটির ভরা যৌবন ছিলো।

এরপর ২০১৭ সাল থেকে সে সময়ের বৃহত্তম গোবিন্দাসী গরুর হাটটি নানা কারণে অধঃপতন শুরু হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারেরাও আসা বন্ধ করে দেয়। সেই সাথে হাটে উঠা গরুর সংখ্যাও কমতে থাকে। যে হাটের সাথে একসময় জড়িত ছিল হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান। আজ ওই মানুষের বেকারত্বে অতি কষ্টে দিন পার হচ্ছে। এতো অল্প সময়ে হাট তার জৌলুস হারিয়ে এতো খারাপ অবস্থানে যাবে, এটা মানুষ সহজে মেনে নিতে পারছেন না।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, হাটের এমন অধঃপতনের পেছনের পেছনে রয়েছে অসংখ্য হাজারো কারণ। হাটের প্রতিটি পয়েন্টে পয়েন্টে আগত ক্রেতা-বিক্রেতার কাছ থেকে অতিমাত্রায় চাঁদাবাজি, ট্রাক থেকে গরু উঠানামার লোড-আনলোড খরচ, অফিস খরচ ও হাটে গরু বাঁধতে একটি বাঁশের আড়ের (ডগা) জন্য প্রতি হাটে পাইকারদের গুনতে হতো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এছাড়াও প্রশাসন কর্তৃক হাটের নির্ধারিত সময়ে নিলাম অনুষ্ঠিত না হওয়াও এ হাটের অধঃপতনের একটি কারণ।

এদিকে হাটের আশের পাশের আবাসিক হোটলে ভাড়ায় গরু রাখায়ও বেপারীদের স্বস্তি ছিলো না। কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী দুষ্কৃতী ব্যক্তিরা ব্যবসায়ীদের গরু চুরি বা গরু মেরে দেওয়া, ছিনতাই ও অর্থ আত্মসাৎ করা মতো এমন রয়েছে বহু ঘটনা। এছাড়াও গরুর বেপারীদের গরু কেনাকাটায় যেসব ব্যক্তি ও সংস্থা স্বল্প লাভে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতো তাদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের এমন অভিযোগও উঠেছে।

হাটের জন্মলগ্নে থেকে যে রওনা ছিল ১০০ টাকা, তা বর্তমান সময়ে বেড়ে হয়েছে ১০০০ টাকা। এমতাবস্থায় হাটের কিছু অসাধু ইজারাদার অতি মুনাফার আশায় রীতিমতো হাটের রওনা বৃদ্ধি করায় ক্রেতারা এ হাট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও হাটে দালালের দৌরাত্ম্য, বেপারীরা অতিমাত্রায় চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মারধরের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

স্থানীয় যুবক শফিক জানান, প্রথমত একটা বেপারী একটা গরু কিনলে এর পেছনে দালাল ঘুরে, দালালের খরচ, খোল, ভিট, ডগা, সব মিলিয়ে দুই-তিন হাজার টাকা খরচ পড়ে যায়। একটা বেপারী যদি ৩০ টা গরু কিনে তাহলে তার অতিরিক্ত ৯০ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়ে যায়। তাছাড়া গরুর গাড়ি ভাড়া, গো-খাদ্য তো আছেই। তিনি আরো জানান হাটে উন্নয়নের কারণে ডগা ও ভিটে টাকা নেওয়া হয় না, অথচ হাটের রওনা কয়েকগুন বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে।

চা বিক্রেতা পয়েন বলেন, আগে হাট এতোটা জম-জমাট ছিলো যে ঈদ মৌসুমে একদিনে যে টাকা বিক্রি করতাম, তা এখন সারা বছরেও বিক্রি করতে পারি না। হাটের অধঃপতনের পেছনে রওনার মূল্য বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি, বেপারিদের টাকা আত্মসাৎ সহ অনেক কারণ রয়েছে।

এ ব্যাপারে গোবিন্দাসী হাটের ইজাদার জাহিদুল ইসলাম খোকা বলেন, এ বছর হাটের ইজারা ৫২ লাখ টাকা। লোকসানের আশঙ্কা জেনেও ঐতিহ্যবাহী গোবিন্দাসী হাটকে আবারও আগের রুপে ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। হাটে গরুর রওনা ধার্য করা হয়েছে ৮শত টাকা। হাটে এ বছর কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। হাটে কোন প্রকার ট্রাক টোকেন, লোড-আনলোড ফি মুক্ত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও কোন প্রকার চাঁদাবাজি, ছিনতাই যাতে না হয় সে লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এই বিষয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম বলেন, হাটে বিভিন্ন ধরণের ছিনতাই, চুরি, জাল টাকা রোধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের নিরাপত্তার লক্ষে সার্বক্ষণিক বিশেষ নজরে রাখবে পুলিশ সদস্যরা।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা: ইশরাত জাহান বলেন, হাটে আসা ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের পক্ষে থেকে সকল ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।