বড় কষ্টে আছে লাখো মানুষ – Newsroom bd24.
ঢাকাশনিবার , ১৮ জুন ২০২২

বড় কষ্টে আছে লাখো মানুষ

রবিউল আওয়াল (স্টাফ রিপোর্টার)
জুন ১৮, ২০২২ ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

 

বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এটি চলতি মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যা। একের পর এক বন্যায় বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি।

নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে উঁচু স্থান, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন মানুষ। অনেকের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে-এক কথায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। বন্যাকবলিতদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য সিলেট ও সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

পানি ঢুকে পড়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও। বিদ্যুৎ স্টেশন ডুবে যাওয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পানি প্রবেশ করায় ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন।

শুক্রবার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বেশিরভাগ এলাকাই পানিতে তলিয়ে যায়। জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাও ছিল পানিবন্দি। পানি বাড়ছে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলায়ও। সিলেট নগরীর অনেক এলাকায়ও পানি প্রবেশ করেছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (শাবি) অন্তত তিনশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যায় আটকা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২১ শিক্ষার্থী।

এছাড়া মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও ভোলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে ভুক্তভোগীরা বলেছেন, তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না।

গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী পশ্চিম ইচলি গ্রামের বৃদ্ধা উম্মে সালমা সাংবাদিকদের বলেন, ‘হামরা পানিতে ভাসি আছি। মেম্বর-চেয়ারম্যান কেউ আইসে নাই। বাঁচি আচি না মরি গেছি কেউ পুসও করে নাই। তোমরা খালি ফটো তুলি নিয়া যান, হামারগুলার জইন্যে কিছু করেন।’

সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন। শুক্রবার তিনি জানান, বন্যার্তদের জন্য নগদ ২০ লাখ টাকা ও ৮ হাজার ব্যাগ শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

এর আগে সাড়ে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বন্যার্তদের উদ্ধার তৎপরতায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, বন্যার্তদের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তবে তাদের নিয়ে আসার জন্য সেই পরিমাণ বাহন নেই।

জানা গেছে, সুরমা ও যদুকাটায় একদিনে অভাবনীয় পরিমাণে বেড়েছে বানের পানি। এরমধ্যে যদুকাটায় ২৪ ঘণ্টায় ২২২ সেন্টিমিটার বা প্রায় ৫ হাত পানি বাড়ে। সুরমার পানি বাড়ে ১২০ সেন্টিমিটার বা ২ হাতের বেশি।

বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বন্যার প্রধান কারণ দেশের ভেতরে আর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে অতি ভারি বৃষ্টি। কোনো অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা স্থানীয় বন্যার সৃষ্টি করে। আর ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ১০ দিনব্যাপী বন্যার বৃষ্টি করে।

সরকারি সংস্থা বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সুনামগঞ্জেরই ছাতকে হয়েছে ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি।

একই জেলার লরের গড়ে ৩২০ মিলিমিটার। সিলেটের জাফলংয়ে ২৬৮ মিলিমিটার আর লালাখালে ১৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যার বড় একটি কারণ ভারতের সন্নিহিত পাহাড়ি এলাকার বৃষ্টি ও ঢল।

সিলেট সংলগ্ন মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৯৭২ মিলিমিটার। একই রাজ্যের শিলংয়ে ১০১, আসামের গৌহাটিতে ৪২ আর ধুব্রিতে ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে আগের দিন (বৃহস্পতিবার) বৃষ্টি হয়েছে ৬৭৪ মিলিমিটার।

আসামের ধুব্রিতে ৬৯ মিলিমিটার। এসব রাজ্যের বৃষ্টি পানি আপার মেঘনা অববাহিকার সুরমা-কুশিয়ারাসহ অন্য নদী হয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জে ঢোকে। এর ফলে এই অঞ্চল এখন বন্যায় ভাসছে।

উল্লিখিত বৃষ্টি পরিস্থিতিতে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের ১০টি নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমোর, ধরলা, তিস্তা, সুরমা, সারিগোয়াইন, পুরাতন সুরমা, যদুকাটা, সোমেশ্বরী ও ভুগাই। এগুলোর মধ্যে বিপৎসীমার সবচেয়ে উপরে আছে যদুকাটা সুনামগঞ্জে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সিলেট অঞ্চলে আসলে এই মুহূর্তে ‘ডাবল’ (দুটি) বন্যা হচ্ছে। সুরমা-সুনামগঞ্জে এখন যে উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে তা ভয়ংকর রূপে আছে। এটি কালই (আজ) অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রবাহিত হতে পারে, যদি গত ২ দিনের মতো পানি আসার প্রবণতা অব্যাহত থাকে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জ : এ অঞ্চলে তৃতীয় দফার এই বন্যা দেখা দিয়েছে বুধবার থেকে। শুক্রবার তা ভয়াবহ রূপ নেয়। বন্যার পানিতে সুনামগঞ্জ ছাড়াও সিলেটের ৭ উপজেলা তলিয়ে গেছে।

সিলেট নগরীর বেশ কিছু এলাকার বাসা, বাড়ি, দোকানপাটে পানি উঠেছে। কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা ভাসছে বানের পানিতে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, আগামী ২৬ জুন পর্যন্ত সিলেটে ভারি বর্ষণ হবে। তাতে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

তিনি জানান, জুন মাসে ৮১৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু ১৬ তারিখ পর্যন্ত ৯৪ দশমিক ৮১ শতাংশ অর্থাৎ ৭৭৪ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে গেছে।

পাউবো সিলেটের উপনির্বাহী প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, আগামী দুদিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি জানান, সুরমা, কুশিয়ারাসহ সিলেটের সব নদ-নদীর পানি সবকটি পয়েন্টেই বিপৎসীমার ওপর।

পানিতে বিদ্যুতের লাইন ও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলা ও সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশন প্রধান, জেওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার অবনতি ঘটেছে। তিনি বলেন, জীবন দিয়ে হলেও মানুষের সেবা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। শপথ নিয়েছি তাদের জন্য কাজ করার জন্য।

তিনি জানান, সিলেট কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানি উঠে বিদ্যুৎ সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি খাদ্যগুদামও হুমকিতে। এগুলো রক্ষায় সেনা সদস্যরা কাজ করছেন। জেওসি আরও জানান, পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারসহ পাঁচটি কাজ করছে সেনাবাহিনী।

স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা, নিজস্ব নৌকা দিয়ে পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার, বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্তদের নিয়ে আসা, বন্যাকবলিত অসুস্থদের চিকিৎসা সহায়তা, সীমিত পরিসরে খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করছেন তারা। সিলেটের তিন উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় কাজ চলছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্যামুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। সেনাবাহিনীও কাজ করছে। তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করেছেন। ইতোমধ্যে কেন্দ্রে ঢুকে পড়া পানি সিটি করপোরেশনের সাকার মেশিন দিয়ে শুকানো হচ্ছে। এই কেন্দ্র ডুবে গেলে সিলেটজুড়ে চরম বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেবে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল কাদির বলেন, পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, কুমারগাঁও উপকেন্দ্র তলিয়ে গেলে দুই জেলার ৯০ শতাংশ সরবরাহই বন্ধ হয়ে পড়বে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৎপর কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা ভবনও পানিতে তলিয়ে গেছে।

সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ বলেন, আগামী সোমবার পর্যন্ত কোনো ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা করবে না। রানওয়ের পাশে পানি উঠে যাওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন জানায়, সিলেটের কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম, লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব, ৫নং বড়চতুল, পৌরসভা ও সদর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানির নিচে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট শহরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

সরকারিভাবে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকার শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন সূত্র।

জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-বশিরুল ইসলাম বলেন, বন্যা পরিস্থিতিতে জরুরি কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। উপজেলায় ২৪টি আশ্রয়ণকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। প্রশাসন থেকে ৬টি ইউনিয়নে ২৪ মেট্রিক টন চাল ও ৫শ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদরে ২ হাজার ৯ বস্তা শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৩৪ টন চাল, ২ হাজার ৯০০ বস্তা শুকনো খাবার ও ১১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ বন্ধে প্রতিমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ : ছাতক ও সুনামগঞ্জ গ্রিড উপকেন্দ্র পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমনটি জানানো হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী সিলেট অঞ্চলের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ামাত্র পুনরায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।

২৯০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ : সিলেটে বন্যার পানিতে শ্রেণিকক্ষ তলিয়ে যাওয়ায় ২৯০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩০টি প্রথামিক ও ৬০ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান।

বন্যার কারণে সিলেটে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। জেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গকুল চন্দ্র দেবনাথ জানান, এ পর্যন্ত জেলায় ২৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে।

এসব বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. ওয়াদুদ জানান, এ পর্যন্ত জেলার ৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা পানিতে তলিয়ে গেছে। এগুলোতে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।

নগরীতে ৩১ আশ্রয়কেন্দ্র : বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিলেট নগরে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে সিলেট মহানগরীতে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

এখনো অনেকেই নিজেদের আসবাবপত্র রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছেন না। তবে বন্যাকবলিত সবাইকে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব। তিনি বলেন, আমরা শহরের বন্যার্তদের জন্য ত্রাণের চাহিদা জেলা প্রশাসনের কাছে দিয়েছি।

আপাতত সিটি করপোরেশনের কাছে যা আছে তাই নিয়ে বন্যার্তদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আসা মানুষজনকে রান্না করা খাবার খাওয়ানো হবে।

খাদ্য সহায়তা দেওয়ার আহ্বান বিএনপির : পানিবন্দি মানুষদের দ্রুত উদ্ধার করে তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি।

জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী, সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালি পংকী ও সদস্য সচিব মিফতাহ্ সিদ্দিকী শুক্রবার পৃথক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান।

আগামী ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাস : এফএফডব্লিউসি জানায়, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের কিছু স্থানে মাঝারি থেকে ভারি আবার কোথাও অতি ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

এর ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমোর, সুরমা, কুশিয়ারা ও গঙ্গা-পদ্মাসহ সব প্রধান নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, দেশের সব নদ-নদীর পানির সমতলই বাড়ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় একদিকে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা, অন্যদিকে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। একই সময়ে বন্যা জামালপুর জেলায়ও বিস্তার লাভ করতে পারে।

নেত্রকোনা, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর : জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে কলমাকান্দার বন্যা পরিস্থিতি নাজুক। এ উপজেলার আটটি ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রাম বন্যাকবলিত।

অসংখ্য রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। তিন সহস্রাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। জেলা ও উপজেলার সঙ্গে ইউনিয়নের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন তিন লক্ষাধিক মানুষ।

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত জানান, কংস, মোমেশ্বরী, ধনু, উব্দাখালিসহ ছোট-বড় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্গাপুর উপজেলার গাওকান্দিয়া, কুল্লাগড়া, বিরিশিরি ইউনিয়নের প্রায় হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

অনেক এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাসেম বলেন, কলমাকান্দার সব এলাকায় এখন বন্যার পানি। ইউএনও কার্যালয়, উপজেলা পরিষদসহ শহরেও হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি।

মানুষকে আশ্রয় দিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, তিনটি উপজেলায় বহু মানুষ পানিবন্দি। বন্যাকবলিত প্রতিটি উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন করে চাল ও নগদ দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শুকনো খাবারসহ ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।

মৌলভীবাজার ও বড়লেখা : বড়লেখায় ১৮ ঘণ্টার টানা ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে উপজেলার তালিমপুর, বর্নি ও সুজানগর ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের অন্তত অর্ধ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। হাকালুকি হাওড়ে অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে হাওরপারের বাসিন্দারা বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন। সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মৌলভীবাজার শহরের কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

রংপুর, কুড়িগ্রাম, ভুরুঙ্গামারী, রৌমারী ও ফুলবাড়ী : তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষিটারি, সদর, গজঘণ্টা ও মর্নেয়া, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, হারাগাছ, টেপামধুপুর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বলপুর ইউনিয়নের তিস্তার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

তলিয়ে গেছে বাদাম, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ধানসহ ফসলি জমি। হাজার হাজার বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকেছে। অনেক বাড়িতে এখন কোমর পানি। এদিকে তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।

মানুষ অনেক কষ্ট করে বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিচ্ছে। গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষিটারি ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে পানিবন্দি বয়স্ক ও শিশুদের নৌকায় করে উঁচু স্থানে নেওয়া হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

তিস্তায় পানি বাড়ায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারি, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা ও কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারি ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত তিস্তা অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে।

এসব এলাকায়ও উঠতি ফসল বাদাম, আমনের চারা, ধান, পাট, ভুট্টা সবজিসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাট ভেঙে যাচ্ছে। দুর্গত এলাকায় বৃদ্ধ ও শিশুদের দুর্দশা চরমে। গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন কেউ কেউ।

কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী জানান, বন্যা আর ভাঙনে আমার ইউনিয়নের দুই হাজার পরিবার বিপদে। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানান, তার ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ডের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবারের সংকট বিরাজ করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তাদের কিছুই দিতে পারিনি।

সিলেট-সুনামগঞ্জকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণার দাবি : ঢাবি ও বশেমুরবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকাকে জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হিসাবে ঘোষণা ও দ্রুত ত্রাণ সহায়তার দাবি জানানো হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা এ দাবি জানিয়েছেন। শুক্রবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত সংগঠন জালালাবাদ ছাত্রকল্যাণ সমিতির ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন হয়েছে।

এদিন বিকালে বশেমুরবিপ্রবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘সিলেট বিভাগীয় ছাত্র কল্যাণ সমিতির’ আয়োজনে মানববন্ধন হয়। মানববন্ধন থেকে ওই দাবি জানানো হয়।

এছাড়া সিলেটকে বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সিলেট জেলা বিএনপি, বাসদসহ আরও কিছু সংগঠন। জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী, বাসদ জেলা শাখার সমন্বয়ক আবু জাফর পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ও সারি নদী বাঁচাও আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করে এই দাবি জানায়।