বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ৫০তম শাহাদত বার্ষিকী।
নড়াইলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূর্য্য সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ৫০তম শাহাদত বার্ষিকী পালিত হয়েছে। তাঁর জন্মস্থান নড়াইলের নূর মোহাম্মদ নগরে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে দিনটি।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ট্রাস্ট ও নড়াইল জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কর্মসূচির মধ্যে ছিল কোরআন তেলাওয়াত, র্যালি, স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, গার্ড অব অনার, আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ।
রবিবার ৫সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের বাস্তভিটায় স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন নড়াইল জেলা প্রশাসন.নড়াইল জেলা পরিষদ.পুলিশ প্রশাসন. বীর মুক্তিযোদ্ধা.সদর উপজেলা পরিষদ.বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ট্রাস্ট.আওয়ামীলীগ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মহাবিদ্যালয়, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।
শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে মহান এই বীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে পুলিশের একটি চৌকস বাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার মিলনায়তনে মহান এই বীরের জীবন ও কর্মের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মোনাজাত শেষে আনুমানিক ১৫০ জন অসহায় দুস্থ মানুষের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়।
এই কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ ফকরুল হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানজিলা সিদ্দিকা, নড়াইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের ছেলে শেখ মোস্তফা কামাল প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ যশোরের শার্শা উপজেলার গোয়ালহাটি গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখে যুদ্ধে শহীদ হন। যশোর শার্শা উপজেলার কাশিপুর গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে “নূর মোহাম্মদ নগর”।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের বাবার নাম মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মায়ের নাম মোসাৎ জেন্নাতুন্নেছা। বাল্যকালে তিনি পিতা মাতাকে হারিয়েছেন। লেখাপড়া করেছেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত।
১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ইপিআর বর্তমানে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ-বিজিবি যোগদান করেন। দিনাজপুর সীমান্তে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে ১৯৭০ সালের ১০ই জুলাই মাসে বদলী হয়েছিলেন যশোর সেক্টরে।পরবর্তীতে তিনি ল্যান্স নায়েক পদোন্নতি পদক পান।
১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮নাম্বার সেক্টরে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে যশোর জেলার শার্শা উপজেলার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন নড়াইলের সাহসী সন্তান নূর মোহাম্মদ।
এ সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮নাম্বার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কমান্ডার ছিলেন মেজর এস এ মঞ্জুর। এদের নেতৃত্বেও লড়েছেন নূর মোহাম্মদ।
৫ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর গুলিতে সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া গুরুতর আহত হলেও সহযোদ্ধাকে কাঁধে নিয়েই এলএমজি হাতে করে শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধে গুলি চালিয়েছেন। হঠাৎ করে পাকবাহিনীর মর্টারের আঘাতে নূর মোহাম্মদের হাঁটু ভেঙে যায়, তবুও গুলি বন্ধ করেন নি। শক্রমুক্ত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোর জেলার গোয়ালহাটি ও ছুটিপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন রণাঙ্গনের লড়াকু সৈনিক নূর মোহাম্মদ।
যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে তার ছেলে গোলাম মোস্তফা কামাল ও তিন মেয়ে আছেন। গত বছর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা ইন্তেকাল করেন।
বীরের সম্মানার্থে নূর মোহাম্মদ নগরে সরকারী ব্যয় হয় ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
২০০৮ সালের ১৮ মার্চ কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত আবু ওসমান চৌধুরী গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করেন। নূর মোহাম্মদের বাড়িতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ নগরে এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় এই বীরের নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ২০০৫ ইং সাল।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির নিম্ন মাধ্যমিক স্তর ১১ বছর পর ২০১০ সালে এমপিওভুক্ত হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিও ভুক্ত হয় নি।
যারা দেশের স্বার্থে প্রান দিয়েছেন, সর্বস্ব ত্যাগ করে রক্তের বিনিময়ে যারা দেশটিকে রক্ষা করেছেন এবং স্বাধীনতা এনেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
তথ্যটি সংগ্রহ করেছেন সাংবাদিক খন্দকার ছদরুজ্জামান-লোহাগড়া।