কিছুদিন আগেই অতীতের নীতি বদলে তালেবানের সঙ্গেও আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার কথা জানিয়েছিল ভারত। তবে সেই শান্তি প্রক্রিয়ার হাল যে এমন হবে, সেটা ভাবতে পারেনি দিল্লি। কাবুল দখলের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েই ভারতের উদ্দেশে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়েছে তালেবান। সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আফগানিস্তানে সেনা পাঠালে বিপদ আছে!
কিন্তু এমন প্রকাশ্য হুঁশিয়ারির পরও তালেবান প্রশ্নে যেন একেবারেই নিঃসঙ্গ ভারত। এমনকি পাশে নেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো মিত্র দেশগুলোও।
তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেছেন, ‘যদি ভারতীয় সেনারা আফগান বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে, তাহলে সেটা তাদের জন্য ভালো হবে না। আফগানিস্তানে অন্য দেশের সেনাদের সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছে। তারা এলে আগে থেকে সব জেনেই আসবে।’
দেশটিতে ভারতের অবদানের অবশ্য প্রশংসাও করেছেন শাহিন। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের মানুষের জন্য সেতু নির্মাণ, পরিকাঠামোর উন্নতিতে অনেক সাহায্য করেছে ভারত। এতে এখানকার অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। এই ভূমিকার আমরা প্রশংসা করছি।’
তিনি বলেন, ‘দূতাবাস ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিদের কোনও ক্ষতি আমরা করবো না। তাদের টার্গেট করা হবে না। আমরা সেটা জানিয়ে দিয়েছি। ভারত তাদের নাগরিকদের জন্য যে চিন্তা করছে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা তাদের কিছু করবো না।’
এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান বিষয়ক কাতার-জোটের পক্ষ থেকে (ভারত, জার্মানি, তাজিকিস্তানসহ কিছু দেশ যার সদস্য) জানানো হয়েছে, সামরিক শক্তি খাটিয়ে আফগানিস্তানে সরকার গঠন করা হলে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। রণকৌশলগত বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই দেশগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া বা না দেওয়ার ওপর ঘটনার গতি আদৌ নির্ভর করছে না।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কোনও সন্দেহ নেই যে ২০ বছর পর তালেবানের এই উত্থানের পেছনে সম্পূর্ণ সহযোগিতা রয়েছে দুই বড় দেশ চীন ও রাশিয়ার। অন্য একটি দেশ পাকিস্তানও যদি আগাগোড়া দলটির পাশে না থাকতো, তাহলে তারা এই অবিশ্বাস্য ঝড়ের গতিতে সামরিকভাবে অগ্রসর হতে পারতো কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জন্য তালেবানের হুমকি যথেষ্ট উদ্বেগের।
এত দ্রুত যে পরিস্থিতির অবনতি হবে, তা ভারতের যাবতীয় অঙ্কের বাইরে ছিল বলেই এখন আঞ্চলিক কূটনীতিতে হতচকিত অবস্থা দিল্লির। অথচ শুধু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নন, বরং কাবুল ও পাকিস্তান নীতি নতুন করে সাজাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশ্বস্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে।
তার তালেবান-দূতিয়ালিও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। বরং নিঃশব্দে পাকিস্তান, ইরান, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে তালেবান নেতৃত্বের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই খুশি। এর বেশি কোনও আন্তর্জাতিক দায় মেটানোর ইচ্ছা ওয়াশিংটনের আপাতত নেই। উপমহাদেশ নিজেদের মধ্যে যুযুধান হলে, তাতে বিশেষ কিছু এসে যাবে না বাইডেন প্রশাসনের, যতক্ষণ না তার আঁচ আমেরিকায় গিয়ে পড়ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়।
সম্প্রতি ভারতের পুরনো মিত্র রাশিয়ার সঙ্গেও তালেবান প্রশ্নে মতবিরোধ ঘটেছে দিল্লির। একই ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাজ্য ও ইরানের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও।
তালেবান রাশিয়াকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। আফগানিস্তানের বাইরে সন্ত্রাস ছড়াবে না। ফলে এ নিয়ে মাথা গলাতে চায় না মস্কো। অনুরূপ আশ্বাস নাকি পেয়েছে ভারতের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু ইরানও।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকেও ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তালেবান যদি ক্ষমতায় আসে তবে তাদের স্বীকৃতি দিতে লন্ডনের কোনও সমস্যা নেই। দিল্লির আশঙ্কা, আফগানিস্তান-পাকিস্তান নীতির ক্ষেত্রেও যুক্তরাজ্যের সমর্থন রয়েছে পুরোপুরি ইসলামাবাদের দিকে।
বৃটেন এটাই বরাবর মনে করে এসেছে, তাদের ভূকৌশলগত অবস্থানের জন্য ইসলামাবাদই পাক-আফগান অঞ্চলের নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে সবচেয়ে কার্যকর। ফলে আফগানিস্তান এবার তালেবান রাষ্ট্র হয়ে উঠলে তাতে পাকিস্তানপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলির ভূমিকা এবং প্রভাব বাড়ার সুযোগ থাকবে। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আপাতত একাই লড়তে হবে দিল্লিকে। সূত্র: আনন্দবাজার।