একজন 'মোতিহার ' এর শুভ জন্মদিন। – Newsroom bd24.
ঢাকাশুক্রবার , ৩০ জুলাই ২০২১

একজন ‘মোতিহার ‘ এর শুভ জন্মদিন।

মোঃ ইমদাদুল হক। (ডেস্ক ঢাকা)
জুলাই ৩০, ২০২১ ৭:৫১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

 

 

কোন জাতি কতটা সভ্য, তা নির্ণয় করার সব চেয়ে উৎকৃষ্ট মাপকাঠি হচ্ছে তার শিক্ষা ব্যবস্থা পাঠ্যপুস্তক ও সাধারণ সাহিত্য।”

 

কথাটা বলেছিলেন একজন বাংলাদেশি যিনি একই সাথে পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।

বলছিলাম কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরির কথা ।

১৮৯৭ সালে তৎকালীন নদীয়া জেলার ভালুকা (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে। পৈতৃক নিবাস রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। মোতাহার হোসেনের পূর্বপুরুষ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দিল্লি-দরবারে ধর্মীয় উপদেষ্টা ও বিচারক (কাজী) পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই সূত্রেই মোতাহার হোসেন ‘কাজী’ পদবী লাভ করেন।

পিতা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ ও মাতা তসিরুন্নেসার আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। বাবা কাজী গওহরউদ্দীনের সরকারি চাকরি ছিল, তাঁর সংসারে অসচ্ছলতা ছিল নিত্য সঙ্গী।

বালক মোতাহারের পড়ার খরচ পুরোপুরি বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই বৃত্তি পেতেন বলে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।

কখনো কখনো বৃত্তির টাকার সংসারে খরচ করে নিজের খরচ চালানোর জন্য টিউশনি বা দীর্ঘমেয়াদী বন্ধে (গ্রীষ্ম বা পূজার বন্ধে) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন তিনি। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেছেন, কিন্তু লেখাপড়া ছেড়ে দেননি।

আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। মেধা, সততা আর আত্মবিশ্বাস একজন মানুষকে যে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে, কাজী মোতাহার হোসেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

যেসব লেখকের সৃজনশীল কর্মকাণ্ড পাঠককে সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কাজী মোতাহার হোসেন তাদেরই একজন। তিনি ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানের শিক্ষক; পরিসংখ্যানে মৌলিক অবদানের জন্য অর্জন করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিও। তিনি বিচিত্র বিষয়ে আলোচনা-আলোকপাত করতে পছন্দ করতেন, যা তার প্রকাশনার দিকে দৃষ্টি দিলেই স্পষ্ট হয়।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যাঁকে অভিহিত করেছেন ‘আপনভোলা নিরহংকার মানুষ, বিদ্বান ও গুণী’ হিসেবে। যাঁকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, “একজন উদারমনা মুসলমান ও সেই সঙ্গে দেশপ্রাণ বাঙালি এবং সকলের উপর একজন সৎ মানুষ।” তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- তাঁর রয়েছে ‘স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষা’, ‘বলবার সাহস’ ও ‘চিন্তার স্বকীয়তা’।

কাজী মোতাহার হোসেন একবার বলেছিলেন, জীবদ্দশায় প্রকাশিত ভালো বইটি পড়তে না পারলে তার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। তার জীবনদর্শন বোঝার জন্য এ বাক্যটিই যথেষ্ট।

এই মানুষটিই বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতা বিকাশের এক অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেনের ঘনিষ্ঠতা তাদের পত্রালাপে ফুটে উঠেছে। কবি নজরুলের একটি চিঠির অংশবিশেষ : ‘…বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্তত তোমার বুক বিঁধে উঠবে।’

ব্যক্তিজীবনের আদর্শের ক্ষেত্রে ছেলেবেলার শিক্ষকদের মধ্যে যতীনবাবুর কথা আজীবন বলেছেন তিনি। যতীনবাবু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, উদারমনা একজন শিক্ষক। এই মানুষটির আদর্শ-শিক্ষা তাঁকে সারাজীবন অনুপ্রাণিত করেছে।

এমনকি তাঁর সাহিত্যের হাতেখড়িও হয় যতীনবাবুর হাত ধরেই। কুষ্টিয়ার রথযাত্রা উপলক্ষে রচনা লেখা প্রতিযোগিতা হয়। সেবার যতীনবাবুর উৎসাহে রচনা লিখে প্রথম হলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সেই থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু।

কাজী মোতাহার হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুষ্টিয়াতেই। মেধাবি ছাত্র হিসাবে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৭ সালে নিম্ন প্রাইমারি ও ১৯০৯ সালে উচ্চ প্রাইমারি পাশ করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে।

এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথমস্থান অর্জন করে মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তিলাভ করেন। ঢাকা কলেজে তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়াল্টার অ্যালেন জেনকিন্স, পদ্মভূষণ ভূপতি মোহন সেন, ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয়শ্রেণীতে প্রথমস্থান নিয়ে এমএ পাশ করেন। উল্লেখ্য, সেবছর কেউ প্রথমশ্রেণী পাননি।

এমএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ডেমোনেস্ট্রেটর পদে চাকরিতে যোগ দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ। তারপর এমএ পাস করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার পদে যোগ দেন।

১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। যুগপৎভাবে, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘Design of Experiments’। তাঁর ডক্টরাল থিসিসে তিনি ‘Hussain’s Chain Rule’ নামক একটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেন। বস্তুত, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) তিনিই প্রথম স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন ১৯৩৮ সালে তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান প্রখ্যাত বিজ্ঞান সাধক প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আগ্রহ ও পরামর্শে কলকাতায় ড. প্রশান্তচন্দ্র মহলনবীশের অধীনে স্ট্যাস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে সংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ে লেখাপড়া করে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতত্ত্ব পড়ানোর ভার নেন এবং সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯২১ সালে এম. এ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন সময়ে কলকাতার তালতলা নিবাসী মোহাম্মদ ফয়েজুর রহমানের কন্যা সাজেদা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।তাঁদের সংসারে চার পুত্র ও সাত কন্যা ছিল।তন্মধ্যে – সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী মাহবুব হোসেন প্রমূখ।

১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। কাজী মোতাহার হোসেনের নিজ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে এম.এ কোর্স চালু হয় এবং তিনি এই নতুন বিভাগে যোগ দেন।তিনি গণিত বিভাগেও ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।

১৯৫১ সালে তিনি পরিসংখ্যানে একজন রিডার ও ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পরিসংখ্যান বিভাগে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তিনি প্রথম পরিচালক। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারী (Professor Emeritus) অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

১৯৫০ সালে ‘Design of Experiments’ বিষয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাজী মোতাহার হোসেন ডক্টরেট (পিএইচ.ডি.) ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর থিসিসের পরীক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ স্যার রোনাল্ড ফিশার। তিনিও তাঁর এই গবেষণাপত্রের উচ্চ প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে মোতাহার হোসেনের উদ্ভাবিত একটি পদ্ধতি সংখ্যাতত্ত্বশাস্ত্রে (Statistics) ‘Hussain’s Chain Rule’ নামে পরিচিতি পায়।

গণিতের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। একদম ছোটবেলায় তাঁর ছোট চাচা কাজী আবুল হোসেন তাঁকে যোগ-বিয়োগ ও গুণের পদ্ধতি শেখান, আর ছোট্ট মোতাহার নিজে নিজেই ভাগ শিখে চাচাকে অবাক করে দেন।

পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যান- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগেই অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ছাত্র। তিনি তাঁর ‘নজরুল কাব্য পরিচিতি’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন প্রিয় শিক্ষক প্রশান্তচন্দ্রকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বোস-আইনস্টাইন থিওরির জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর লেখা ‘তথ্য-গণিত’ বইটি সত্যেন বোসকে দেখানোর জন্য কলকাতায়ও গেছিলেন।

আরো অনেকের সামনে সে বইয়ের ভূমিকা পড়ে বোস বলেছিলেন, “দেখ! তোমরা কেউ লিখতে পারতে? পারতে না। এ আমার ছেলে!” শুধু তা-ই নয়, সত্যেন বোস তাঁর জীবনের শেষ চিঠিটিও লিখেছিলেন মোতাহার হোসেনকে ।

ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি এ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি; সংগঠনের মুখপত্র ছিল শিখা পত্রিকা। শিখায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিভিন্ন তথ্য এবং সাহিত্য সভায় পঠিত রচনা প্রকাশিত হতো। এর মুখবাণী ছিল-‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রধান তিন ব্যক্তিত্ব ছিলেন-কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন ও কাজী মোতাহার হোসেন।

এ সংগঠনের অনুরাগী ও সভায় অংশগ্রহণকারী ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র বলেছিলেন, এ সংগঠনের মস্তিষ্ক হলেন কাজী আবদুল ওদুদ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আবুল হুসেন আর হৃদয় কাজী মোতাহার হোসেন।
শিখার মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেন; দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন।

অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী এবং সেই আলোকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুদৃঢ় ভিত গড়ে তোলার জন্য তিনি লেখনী পরিচালনা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবীতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার একজন দৃঢ় পৃষ্ঠপোষক।

বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রবন্ধাদি প্রকাশ করে এ-সব আন্দোলনে গতিদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ৬-দফাকে কেন্দ্র করে ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে আন্দোলন সংঘটিত হয় তারও একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাজী মোতাহার।
১৯৬১ সালে প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার মুখে ঢাকায় রবীন্দ্র-জন্মশত বার্ষিকী পালনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি-সংস্কৃতি খর্ব করার জন্য রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদজ্ঞাপন করেন।

কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টাদের মধ্যে একজন।

তিনি বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সভাপতি হন।

একজন আপাদমস্তক সঙ্গীতানুরাগী মানুষ ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। কবি নজরুলের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার একটা বড় কারণ ছিল দুজনেরই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ। কুষ্টিয়ায় স্কুলে পড়ার সময় থেকে তাঁর সঙ্গীতচর্চা শুরু হয়। পরে ১৯১৭-১৮ সালে তিনি বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ হাকিম মোহাম্মদ হোসেনের কাছে দু’বছর টপ্পা, ঠুমরি ও খেয়াল শেখেন।

পরে এঁর কাছেই বছর তিনেক সেতারের তালিমও নিয়েছিলেন। সন্তান-সন্ততিদেরও সঙ্গীত-শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন মোতাহার হোসেন। তাঁর মেয়ে সনজীদা খাতুন ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

কাজী মোতাহার হোসেনের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। বিভিন্ন চিঠিতে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ‘মোতিহার’ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁদের সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল যে, মোতাহার হোসেনের দাড়ি-কাটা নিয়ে নজরুল ‘দাড়ি-বিলাপ’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতাও লিখেছিলেন।

কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথেও মোতাহার হোসেনের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমনকি শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটিও মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতারই ফসল।
ড. কাজী মোতাহার হোসেন নজরুল সম্পর্কে অনেকগুলো প্রবন্ধ ও একটি গ্রন্থ রচনা করেন।

মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার তাগিদ সবসময়ই অনুভব করেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সে চিন্তা থেকেই রচনা করেন ‘তথ্য-গণিত’, ‘গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস’, ‘আলোক-বিজ্ঞান’ নামের বইগুলো। বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের বিখ্যাত ‘কোয়ান্টাম-থিওরি’ সম্পর্কিত প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন এবং তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের অগ্রগন্য ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেন একইসাথে একজন দাবা অনুরাগীও ছিলেন। তাঁর দাবাখেলার সঙ্গী ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সতীশচন্দ্র আড্ডী (সর্বভারতীয় চ্যাম্পিয়ন), কিষাণলালের মতো বিখ্যাত লোকেরা। ১৯২৫ সালে তিনি ‘অল ইণ্ডিয়া চেজ ব্রিলিয়ান্সি’ প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। কাজী মোতাহার হোসেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন। ফুটবল, টেনিস, হাই জাম্প, সাঁতার এবং ব্যাডমিন্টনেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল। ১৯৫১ সালে ঢাকায় লন টেনিস প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন হন।

১৯৬১ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানে কাজী মোতাহার হোসেনের উদ্যোগেই সর্বপ্রথম ‘পূর্ব পাকিস্তান দাবা সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া সৈয়দ জাহিদ মানসুরের সাথে মিলে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অল পাকিস্তান দাবা ফেডারেশন’, তিনি হন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

১৯৪৭ সাল থেকে পুর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি দাবা চ্যাম্পিয়নশীপ শুরু হলে কাজী মোতাহার হোসেন হন সেই সময়ের চ্যাম্পিয়ন। ১৯৬১ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান দাবা সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হলে শুরু হয় অফিসিয়াল প্রতিযোগিতা। কাজী মোতাহার হোসেন চ্যাম্পিয়ন হন তখনও এবং এই ধারা অব্যাহত রাখেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত।

তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে কিউ এম হোসেন আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা। আজীবন জ্ঞানসাধক এই ব্যক্তি সমধিক পরিচিত ‘দাবাগুরু’ নামেও।

কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে যত কথা লেখা হয়েছে, তাতে তাঁর আত্মভোলা চরিত্র আর দাবা খেলার নেশার কথাই উঠে এসেছে বেশি। কেউ কেউ সেটা শুধরে নিয়ে বলেছেন, তিনি আত্মভোলা ছিলেন না, ছিলেন আত্মমগ্ন এক মানুষ।

কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে যত কথা লেখা হয়েছে, তাতে তাঁর আত্মভোলা চরিত্র আর দাবা খেলার নেশার কথাই উঠে এসেছে বেশি। কেউ কেউ সেটা শুধরে নিয়ে বলেছেন, তিনি আত্মভোলা ছিলেন না, ছিলেন আত্মমগ্ন এক মানুষ।

মজার একটা ঘটনা বলি:-

পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিক পালন করতে দেবে না । তবুও আয়োজন করা হল কিছু ঘাড়তেড়া লোকের প্রবল সাহসে ।

১৯৬১ সালের মে মাসে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনজন বিশিষ্ট মানুষ গিয়েছিলেন সিলেটে। তাঁরা হলেন কাজী মোতাহার হোসেন, গোবিন্দচন্দ্র দেব (জিসি দেব) ও বেগম সুফিয়া কামাল। মোতাহার হোসেনের দাবার নেশার কথা সেখানেও সবাই জানতেন। দাবার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলে তখনকার তরুণ সালেহ চৌধুরীর ওপর পড়েছিল কাজী সাহেবের দেখভালের ভার। রশিদ মঞ্জিলে হয়েছিল তাঁর থাকার ব্যবস্থা। বাসায় পৌঁছেই সালেহ চৌধুরীকে ডেকে কাজী সাহেব বললেন, ‘শুনেছি, সিলেটে ভালো দাবা খেলোয়াড় আছেন। এখনই কয়েকজন দাবা খেলোয়াড়কে নিয়ে আসেন।’

সালেহ চৌধুরী নিয়ে এলেন আজিজুর রহমান, ফণী বাবু আর আবদুল করিম চৌধুরীকে। কাজী সাহেব খুব ভালো দাবা খেলেন। সংগত কারণে কেউই তাঁর সঙ্গে দাবা খেলায় উৎসাহী ছিলেন না। সালেহ চৌধুরীরা নিজেরা সলা করে ঠিক করলেন, চারজন মিলেই কাজী সাহেবের বিরুদ্ধে খেলবেন তাঁরা। কাজী সাহেব কানে কম শোনেন, তাই দাবার চাল দেওয়ার সময় ফিসফিস আলোচনা করে নেওয়া যাবে। সেভাবেই প্রথম দান হলো এবং যা হওয়ার তা–ই হলো, কাজী সাহেব হারলেন। খেলায় জিতে চারজন তো দারুণ খুশি। কিন্তু কাজী সাহেবের কথা শুনে তাঁদের আক্কেলগুড়ুম! স্বভাসুলভ ধীরকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বুড়ো তো হারল, সবাই খুশি তো? ভেবেছেন, বুড়ো কানে শোনে না, কিছুই বুঝবে না! তবে বুড়োর চোখ তো আছে, ঠোঁট নড়া তো দেখতে পায়।’

খুবই লজ্জা পেলেন তাঁরা। এরপর একা একা যে কটা দান খেললেন,প্রত্যকে হারলেন , জিতে গেলেন মোতাহার হোসেন ।

প্রগতিশীলতার চর্চা করতে গেলে, প্রচলিত নষ্ট সমাজব্যবস্থার সংস্কার চাইলে ধর্মান্ধ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা খড়গ হাতে নেমে পড়েছে সব যুগেই। শিখাগোষ্ঠীও এর বাইরে ছিল না। কাজী আবদুল ওদুদ বা আবুল হোসেনদের মতো নিগৃহীত বা অপমানিত না হলেও ধর্মান্ধদের রক্তচক্ষুর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে কাজী মোতাহার হোসেনকেও। তবু মোতাহার হোসেন বলে গেছেন-

‘আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে চাই না – আমরা চাই বর্তমান মুসলমান সমাজের বদ্ধ কুসংস্কার এবং বহুকাল সঞ্চিত আবর্জনা দূর করিতে।’

কাজী মোতাহার হোসেন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, ধর্মান্ধ ছিলেন না। ১৯৬৬ সালে সস্ত্রীক হজ্জব্রতও পালন করেন তিনি। মোতাহার হোসেন যা বিশ্বাস করতেন, মোতাহার হোসেন যে স্বপ্ন দেখতেন- কোনো ভণ্ডামি না করেই তিনি তা বলতে পারতেন। ব্যক্তিজীবনে এভাবে সততা এবং সরলতার চর্চা করার মানুষ এ সমাজে বিরল।

তিনি ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত তাঁর একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থে ‘সঞ্চরণ’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়েরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর অনেক বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে সঞ্চয়ন (১৯৩৭)(প্রবন্ধ সংকলন), নজরুল কাব্য পরিচিতি(১৯৫৫), সেই পথ লক্ষ্য করে(১৯৫৮), সিম্পোজিয়াম(১৯৬৫), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস(১৯৭০), আলোক বিজ্ঞান(১৯৭৪), নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৭৬), প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ-১৯৬৫)অন্যতম।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং বিজ্ঞান চর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে দেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে। ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ডি.এস.সি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে।

কাজী মোতাহার হোসেন ভবন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের নতুন নামকরণ করা হয়

 

 

১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর ৮৪ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় নিজ বাড়িতেই মৃত্যুবরণ করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম জাকী মোতাহার হোসেন কে ‘মতিহার ‘ বলেই ডাকতেন ।

দারিদ্র্যের যাতাকলে পিষ্ট ১৮৯৭ সালের আজকের দিনে ( ৩০ জুলাই) জন্ম নেয়া মোতাহার বাংলা সাহিত্যে সত্যিকারের “মোতিহার ( মোতির হারঃ- যেখানে পদার্থ , পরিসংখ্যাং , সাহিত্য, মুক্তবুদ্ধি , প্রগতিশীল চিন্তা সব এক সাথে মিশে যেন সত্যিকারের হার ) ” হয়ে উঠেছিলেন ।

 

নিউজরুম বিডি ২৪.পরিবার শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে একজন “কাজী মোতাহার হোসেন ” এর শুভ জন্মদিন।