এলোমেলো (প্রসঙ্গ ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ম্যাচ)
মেসির খুব বড় ভক্ত আমি কখনোই ছিলাম না। যেখানে দুনিয়াজুড়ে মানুষ দলমত নির্বিশেষে মেসিকে নিয়ে পাগল, সেখানে আমার এই কথায় খটকা লাগতেই পারে। লাগলেও কিছু করার নেই।
আমি পরিষ্কার করেই বলি, খুব বেশি ফুটবল পাগল মানুষ আমি না। সারা বছর ধরে যত খেলা চলে, তার কোনও খোঁজ কখনোই রাখা হয় না। ফুটবল আমি দেখি মাঝে মাঝে। বিশ্বকাপ কিংবা কোপা আমেরিকা আর ইউরোর মতো টুর্নামেন্ট এর খেলা গুলোই দেখা হয়। খুব বেছে বেছে শুধু বড় দলের খেলা থাকলে, আর তাও সবকিছু অনুকূল থাকলে তখনই দেখা হয়। অতএব বলাই যায় যে ফুটবল পাগল বলতে যা বোঝায় আমি তা না।
ভাবছেন, আমি ফুটবল পাগল না এমনি পাগল তাতে কার কি যায় আসে? কথা সত্যি, তাতে কারো কিছু যায় আসে না।
তবে যায় আসে তখন, যখন এই কথাটি বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। জী, এটাই বলতে চাইছি এতক্ষণ ধরে। এখানে বেশিরভাগ মানুষ সারা বছর ফুটবলের খোঁজ খবর রাখেনা, এমন কি নিজের দেশের ফুটবল নিয়ে ভাবার সময়ও কারো নেই। কোনো খবর রাখেনা কবে দেশের কোন্ লীগ বা টুর্নামেন্ট চলে। অথচ বিশ্বকাপ খেলার সময় অথবা ব্রাজিল আর্জেন্টিনার ম্যাচ গুলোতে দুই দলে ভাগ হয়ে রীতিমত যুদ্ধে নেমে পড়ে এই মানুষগুলোই। বন্ধুত্বের সম্পর্কে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরে। মাঝে মাঝে তা হাতাহাতি মারামারির পর্যায়ে চলে যায়।
ফিরে যাচ্ছি আবার মেসি প্রসংগে। যেহেতু আমি ফুটবল পাগল না আর সারা বছর ধরে চলা খেলাগুলো দেখার সুযোগ বা আগ্রহ তেমন হয়না, আমি তাই মেসিকে দেখি নিজের চোখে দেখা খেলা গুলোতে তার পারফরম্যান্স দিয়ে। তা দিয়েই তাঁকে মাপি। সে সারা বছরে বিদেশী লীগ গুলোতে কি করলো না করলো তা যেহেতু দেখার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই হয় না, আমি তাকে বিবেচনা করি বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকার পারফরম্যান্স অনুযায়ী।
এটাই হওয়া স্বাভাবিক মনে হয় আমার কাছে। আজকের ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ম্যাচ এর কথাই যদি ধরি, আজকেও একবারো মনে হয়নি সে এমন কিছু খেলেছে যাতে মনে হতে পারে সে ভিনগ্রহের কোনো ফুটবলার। আমি ছোটো থেকে ফুটবল বুঝতে শিখেছি দিয়েগো ম্যারাডোনার খেলা দেখে। ওই সময় তার সাথে ছিলো বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়া, ওরতেগা, জেনেত্তির মতো ফুটবলাররা। ম্যারাডোনার ফুটবল জাদুর ঝলক দেখে মুগ্ধ হয়ে আর্জেন্টিনাকে চিনেছি। চেনা থেকে আর্জেন্টিনাকে ভালো লাগা। এরপর ভক্ত হয়ে উঠা। অথচ ম্যারাডোনা যুগের সমাপ্তির পর এতগুলো বছর বড় আসর গুলোতে একই দলকে সমর্থন করে গেলেও, একবারও মনে হয়নি এমন কোনো দলকে সমর্থন করছি যাকে নিয়ে গর্ব করতে পারি। যাকে নিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার পছন্দ সেরা পছন্দ।
একের পর এক ব্যর্থতায় নিঃশেষ হয়ে আসছিল ভালোবাসা। এবারের কোপা ফাইনালেও ধরেই নিয়েছিলাম হারবে আর্জেন্টিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিতেছে , জিইয়ে রেখেছে হারাতে বসা ভালোবাসা। হয়তো ভাবছেন এটা কেমন ভালোবাসা, জিতলে ভালোবাসা রয়ে যাবে, হারলে হারিয়ে যাবে? ভালোবাসা কেনো এমন স্বার্থপরের মতো হবে? আসলে কি তাই? আমি কি স্রোতের বিপরীতে চলা একজন? হয়তো তাই। তবে এটাই কি হওয়া উচিত নয় ? আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল অথবা ইতালী কিংবা ফ্রান্স ওদের খেলা আমরা ভালোবাসি, ওদের সমর্থন করিতো শুধু ওদের কিছু ফুটবলারদের অতি মানবীয় খেলা দেখে।
আমি যেমন ম্যারাডোনাকে দেখে ফুটবলের ভক্ত হয়েছিলাম, এরপর তার দল যেহেতু আর্জেন্টিনা, তাই আর্জেন্টিনার সমর্থন করতে শুরু করি। এই জেনারেশন তেমনই মেসিকে দেখে আর্জেন্টিনা, কেউ নেইমারকে দেখে ব্রাজিলের সমর্থন করে। এ পর্যন্তই ঠিক আছে। এর বেশি কি খুব বেশি কিছু করার আছে আমাদের? এর কোনোটাই আমার দেশ না, যে এর জন্যে আবেগের অতিশয্যে আমি রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে দেবো।
আমার ব্যাক্তিগত মতামত যদি জানতে চান, আমি বলবো আর্জেন্টিনা জেতাতে আমার ভালো লেগেছে ঠিক, কিন্তু তার চেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে নেইমারকে কাঁদতে দেখে। কারণ আমি ফুটবল দেখি এই মানুষগুলোর জন্যে। দেশ দেখে না, কারণ দেশ বলতে আমি নিজের দেশকেই বুঝি। হা এটা ঠিক যে, এই বিদেশী খেলোয়াড়দের মাঝে যাকে বেশি ভালো লাগে, বা ছোটবেলায় যাকে ফুটবল হিরো জেনে এসেছি তার দলের প্রতি একটা আলাদা দুর্বলতা আছে। কিন্তু তাই বলে তা অন্ধের মতো না। এতোটা না যে এই খেলার জন্যে আমি আমার বন্ধুত্ব নষ্ট করবো, এতটা না যে এর জন্যে আমি আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলা, চেহারা দেখা বন্ধ করে দেবো। এতোটা না যে এর জন্যে মারামারি, হাতাহাতি করতে শুরু করবো।
ভালোলাগা ভালোবাসা থাকবেই, আবেগের উপস্থিতিও স্বাভাবিক, কিন্তু তাই বলে অতি আবেগে রক্তারক্তি ঘটবে, এটা স্বাভাবিক না। আবেগটা যদি মানবীয় হয়, তাহলে যাকে সমর্থন করি সেই দলের জয়ে যেমন আনন্দিত হওয়া যায়, অন্যদিকে পরাজিতদের কাঁদতে দেখলে কষ্ট হওয়া উচিত। সত্যিকার আবেগ থাকলে কাদা ছোড়াছুরি না করে যে হেরেছে তাকে বুকে টেনে নিয়ে চুপ করে থাকা উচিত।
ব্যাপারটা যদি এমন হতো যে আপনি আর আপনার স্ত্রী দুজনেই বাংলাদেশী, জন্মেছেন বেড়ে উঠেছেন এবং থাকছেন এই দেশেই। এবার ধরুন এই বাংলাদেশ খেলছে বিশ্বকাপে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা কারো সাথে। আপনি দেখলেন আপনার স্ত্রী সমর্থন করছে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার। তখন যদি সেখানে মারামারি, হাতাহাতি বা আরো বেশি কিছু হয়, সেটা না হয় মানা যায়। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশের দলের সমর্থন করতে গিয়ে এমন করাটা স্বাভাবিক না।
বিশ্বাস করুন, এই সমর্থন যদি আমরা আমাদের দেশের ফুটবলের জন্যে দেখাতাম, তাহলে দেশের ফুটবল এগিয়ে যেতো অনেকটা। জানেন, যদি দেখতে শুরু করেন দেশের খেলাগুলো, তবে এই দেখতে দেখতেই ভালো লাগতে শুরু করবে আমাদের ফুটবল। দল গুলোকে চিনতে শুরু করবেন, আমাদের স্টার প্লেয়ার গুলোর নাম জানতে শুরু করবেন, ওদের নিয়ে চায়ের টেবিল এ ঝড় উঠবে, জমে উঠবে এ দেশের টুর্নামেন্ট বা লীগ।
মাঠে দর্শক হলে খেলোয়াড়দেরও জান দিয়ে খেলতে ভালো লাগে, তাদের মাঝে হিরো হবার স্বপ্ন জাগে, আর তা থেকে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। ভাবতে অবাক লাগে, একসময় এই দেশে ফুটবল দেখতে মাঠে দর্শক উপচে পড়তো, গ্যালারি তে জায়গা না পেয়ে স্টেডিয়াম এর বাইরেও দশ বিশ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে থাকতো।
আমাদের খেলার চ্যাম্পিয়ন দলের সমর্থকরা বিশাল বিশাল আনন্দ মিছিল বের করতো। কে কোন দলের কতো বড় পতাকা বানাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা চলতো। আমাদের ছিলো সালাউদ্দিন, সালাম, আসলাম, মুন্না, মহসিন, সাব্বিরেরা। এদের অটোগ্রাফ নিতে ভিড় করতো মানুষ, কোথাও গেলে ভিড় লেগে যেতো। কোথায় গেলো ওই দিনগুলো। কয়জন জানেন আমাদের দেশের লীগে এখন কোন কোন দল খেলে। কে কোন দলের সুপার স্টার। শেষ কবে লীগ বা কোনো টুর্নামেন্ট হয়েছে তাই বা কয়জন খবর রাখেন?
বুঝলাম নাহয়, যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্ব পর্যায়ে খেলে না, তাই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইতালী, ফ্রান্সের সমর্থন করেন। কিন্তু তাই বলে তা যেনো অতিরিক্ত কিছু না হয়। Sportsmanship বলে একটা কথা আছে, তা থাকা উচিত সবার মাঝেই আর সাথে দেশের খেলার জন্যে ভালোবাসা।
দেশের খেলোয়াড়দের জন্যে ভালোবাসা। তাহলেই এই আনন্দ থেকে কিছু অর্জন আসবে। তা না হলে এই আনন্দ হবে ধ্বংসাত্তক আনন্দ।
মুহিত মিলকী